
রাস্তায় কুকুরের উপদ্রব থেকে সুরক্ষার দাবিতে আইনি নোটিশ
রাস্তায় কুকুরের উপদ্রব থেকে সুরক্ষার দাবিতে আইনি নোটিশ
নিউজ ডেস্ক : রাস্তার কুকুরের উপদ্রপ থেকে দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে কুকুর নিধন কার্যক্রম শুরু করার জন্য রাজধানীর সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন ঢাকা জর্জকোর্টের আইনজীবি এডভোকেট মুহম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি এডভোকেট শেখ ওমর শরীফ নোটিশটি প্রেরণ করেন।
নোটিশে বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, জীবনরক্ষার অধিকার বাংলাদেশের নাগরিকগণের একটি মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের জীবন ও দেহ সুরক্ষার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না। সুতরাং বাংলাদেশের নাগরিকগণের জীবন ও দেহ সুরক্ষা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার বাস্তবায়নে আইনসঙ্গত যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের নাগরিকগণের জীবন ও দেহ সুরক্ষা করা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা। সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত আছে: আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। সুতরাং বাংলাদেশের নাগরিকগণের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করা কেবল রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বই নয়, বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম মূল লক্ষ্যও বটে। সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরাকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু রাস্তাঘাটে বেওয়ারিশ কুকুরের ধাওয়া, পথচারীদের ওপর কুকুরের হিংস্র আচরণ, ধারালো দাঁত দিয়ে শিশুসহ লক্ষ লক্ষ মানুষকে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করার ঘটনা এবং সর্বোপরি কুকুরের কামড়ে গত বছরগুলোতে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় দেশবাসী এখন কুকুরের ভয়ে আতঙ্কিত।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, দেশজুড়ে লাখ লাখ বেওয়ারিশ কুকুরের উৎপাতের কারণে দেশের নাগরিকগণ বর্তমানে দেশে অবাধে ও নির্ভয়ে চলাফেরা করার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৬৫ মানুষ কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিবছর কুকুরে কামড় খাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৪২ শতাংশই আবার শিশু, যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে প্রতিদিন ঢাকা ও আশপাশের এলাকার দুই শতাধিক মানুষ কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন। ২০১৮ সালে কুকুরের আক্রমণে আহত ৮১ হাজার রোগী সেবা নিয়েছেন হাসপাতালটিতে। ২০১৯ সালে রোগী ছিল ৭৬ হাজার। আর ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৩৬ হাজার লোক কুকুরে আক্রমণের পর সেবা নিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর সাড়ে ৩ লাখ লোক কুকুরের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। ৬৪ জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে থাকা জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কেন্দ্রের প্রতিটিতে দিনে গড়ে ১৫ জন আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশব্যাপী কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি।
নোটিশে আরো উল্লেখ করা হয়, পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশেই রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুর অবাধে ঘুরতে দেয়া হয় না। বেওয়ারিশ কুকুর নিরাপদ সড়কের বড় অন্তরায়। বিশেষ করে বহু সংখ্যক মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুরের অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের ভূমিকা রয়েছে। রাতের বেলায় রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরপালের মাত্রাতিরিক্ত চিৎকার-চেচামেচিতে ঘরের ভেতর অসুস্থ বোধ করছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা- যা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার ভীষণভাবে লঙ্ঘন করছে। বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীকেও বেওয়ারিশ কুকুর কামড়ে আহত-নিহত করছে। ফলে অনেক খামারি-কৃষক শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছেন না, বরং আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের স্বাধীনতার মতো একটি সাংবিধানিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুড়িগ্রামে প্রায় এক মাসে কুকুরের কামড়ে ৪৩টি গরু ও আটটি ছাগল মারা গেছে। এর মধ্যে নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নেই ২৩টি গরু মারা গেছে। একই সময়ে কুকুর ১০ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে কামড়েছে। অতি সম্প্রতিও নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলায় কুকুরের কামড়ে শিশু ও নারীসহ অন্তত ১৪ জন আহত হয়েছেন। একইসঙ্গে ২০টি গরু-ছাগলকেও কামড়ে দিয়েছে কুকুর। গত ১ অক্টোবর ২০২০ থেকে ২ অক্টোবর ২০২০ এই দু’দিনে বড়াইগ্রাম উপজেলার গোয়ালফা ও জোয়ারী ইউনিয়নের কেল্লা গ্রামে এসব ঘটনা ঘটে।
নোটিশে প্রাণিকল্যাণ আইন উল্লেখে বলা হয়, প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯-এও সংবিধান প্রদত্ত জনগণের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯”-এর ৬(৪) ধারায় বলা হয়েছে: এই ধারার ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, প্রাণীর প্রতি নিম্নবর্ণিত আচরণ বা কার্য অপ্রয়োজনীয় নিষ্ঠুর আচরণ হিসাবে গণ্য হইবে না, যদি-
(ক) নিষ্ঠুরতাটি যৌক্তিকভাবে পরিহার বা হ্রাস করিবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়;
(খ) নিষ্ঠুরতাটি সৎ উদ্দেশ্যে, যেমন – উক্ত প্রাণি বা অন্য কোনো প্রাণির উপকার অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি বা অন্য কোনো প্রাণির প্রাণ সংশয়ের হুমকি নিরসনের জন্য করা হয়। অর্থাৎ নাগরিকদের “প্রাণ সংশয়ের হুমকি নিরসনের জন্য” অথবা তাদের পোষা বা পালিত প্রাণীর “প্রাণ সংশয়ের হুমকি নিরসনের জন্য” কুকুর নিধনের অধিকার প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯-এ দেয়া হয়েছে। রাস্তায় চলাচলসহ যাবতীয় নিরাপত্তা পাওয়া জনগণের মৌলিক অধিকার (সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ)। রাস্তায় বেওয়ারিশ কুকুরের কারণে যদি নাগরিকের চলাচলে সমস্যা হয়, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কুকুর নিধন করে জনগণের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা। তাই ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী কুকুরের উপদ্রবের দ্বারা বাংলাদেশের নাগরিকগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষিতে কুকুর নিধনে কার্যকর ও আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। নাগরিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র যেভাবে মশক নিধন কার্যক্রম গ্রহণ করে, একইভাবে নাগরিকগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় কুকুর নিধন কার্যক্রম গ্রহণ করাও রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। বাংলাদেশের নাগরিকগণের কোনো আইনসঙ্গত অধিকার লঙ্ঘন হলে সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশের “সকল নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সুতরাং বাংলাদেশের নাগরিকগণের জীবন ও দেহ সুরক্ষা, ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, চলাফেরার অধিকার কোনো কিছুর দ্বারা লঙ্ঘিত হলে তার প্রতিকারের জন্য বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক সাংবিধানিকভাবে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী।
নোটিশে আগামী ৫ দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী বেওয়ারিশ কুকুর নিধন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজধানীর উভয় সিটি করপোরেশকে কার্যক্রম গ্রহণের আহবান জানানো হয়েছে। অনথ্যায় নোটিশদাতা উপযুক্ত আদালতে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন।
লিংক-https://bisshobarta24.com/2020/10/%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%89%e0%a6%aa%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%ac-%e0%a6%a5/
Post a Comment